গেমিং ডিসঅর্ডার: সমস্যা ও প্রতিকার।
মো:কাউছার হামিদ।
____________________________
স্মার্টফোন আছে অথচ কখনো গেম খেলেনি; এমন মানুষ নেই বললেই চলে। প্রযুক্তির এই অখ- প্রতাপের যুগে স্মার্টফোনে প্রায় সবাই গেম খেলে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কথা না বললেই নয়। তাদের কেউ আবার কম্পিউটারও ব্যবহার করে। তবে সহজলভ্য হওয়ায় স্মার্টফোনেই বেশি গেম খেলে। কেউ অনলানে, কেউ অফলাইনে; কেউ কম, কেউ বা বেশি। তবে এই ‘বেশিটা’ যখন মাত্রা অতিক্রম করে, অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন কাজ-কর্মের উপর কেউ যদি গেমিংকেই প্রাধান্য দেয়, এর ক্ষতিকর দিকগুলো জানা সত্ত্বেও অনবরত তা খেলেই যায় এবং কোনো ক্রমেই এ থেকে নিষ্কৃতি না পায়, তবে তাকে ‘গেম-আসক্তি’ বলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এটিকে অবশ্য ‘Gaming Disorder’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।[১]
প্রিয় পাঠক,
বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা জানবো, অনলাইন গেম- আসক্তির উপসর্গসমূহ এবং এর ক্ষতিকর দিকগুলো। তারপর এই মারাত্মক আসক্তি থেকে উত্তরণের পথ/উপায় নিয়ে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রথমেই আমরা তুলনামূলক একটি পার্থক্য দেখবো। এই পার্থক্যটি হলো— নিকট অতীত এবং বর্তমান সমাজের তরুণ-যুবাদের কার্য-কলাপের। এর ফলে বোঝতে পারবো, আজকের তরুণ-যুবাদের মধ্যে অনলাইন ভিডিও গেম-আসক্তি কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
বছর ছয়েক আগেও, যখন মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন অতটা সহজলভ্য ছিলো না, ইন্টারনেটের এতো অবাধ ব্যবহার ছিলো না; তখন গ্রাম-গঞ্জের তরুণ-যুবাগুলো অবসর পেলেই মাঠে বেরিয়ে পড়তো।
যদিও আমাদের জাতীয় খেলা ছিলো কাবাডি, তা সত্ত্বেও ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা নিয়েই সবাই মেতে উঠতো। এমন কোনো দিন গত হতো না, যেদিন বিকেলে ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলার ধুম চলতো না।
গ্রীষ্ম কিংবা শীতকালীন অবকাশে যখনই সবাই
গ্রামের বাড়ি ফিরতো, তখনই সবাই মিলেমিশে প্রীতি ফুটবল কিংবা ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করতো। খেলায় হার-জিতের পুরষ্কার তো থাকতোই, শেষে বিরিয়ানির পার্টির আয়োজনও হতো। সে এক অপার আনন্দের কথা! এতে করে একদিকে যেমন সুষ্ঠু বিনোদন পাওয়া যেত, অন্যদিকে সামাজিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনও অটুট থাকতো!
কিন্তু হায়! আজকের যুব সমাজের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। বছর ছয়েক আগের কথাগুলোও এখন রূপকথার গল্প বলেই মনে হয়।
প্রিয় পাঠক,
এখন যদি বিকেল বেলা একটু প্রমোদভ্রমণে বেরোনো যায়; চোখের লেস্নে স্পষ্টই দেখা যায় জটলা বেধে রাস্তার ধারে বসে থাকা উম্মাহর তরুণ-যুবাদের করুণ চিত্র! যাদের হাতে একটি করে স্মার্টফোন এবং তাতে তারা অনলাইনে ভিডিও গেম খেলায় মত্ত!
মোবাইল-স্কিনের দিকে ঝুঁকে গেম খেলায় তারা এতোই নিমগ্ন থাকে যে; পাশ দিয়ে কেউ গেলেও বিলকুল টেরই পায় না!
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, উপর দিয়ে যদি গাড়িও চালিয়ে দেয়, তবু অতটুকু খেয়াল করবে না এই বেচার দল! খেলায় নেশায় এমনই আচ্ছন্নে বুঁদ হয়ে দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন হয়ে পড়ে— উম্মাহর এই তরুণ-যুবাগুলো!
এই হলো আমাদের অঁজপাড়া গায়ের তরুণ-যুবাদের অনলাইন ভিডিও গেম-আসক্তির একটা খন্ড চিত্র! শহরের ধনীর দুলাল-দুলালীদের অবস্থা কেমন হবে তা তো সহজেই অনুমেয়!
★উপসর্গ/লক্ষণ:
উপরের চিত্র থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, উম্মাহর তরুণ-যুবাদের মধ্যে ক্রমেই অনলাইন ভিডিও গেম-আসক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে; এটা যে একটা ‘মানুসিক অসুস্থতা’ তা অনেকেই জানে না কিংবা বুঝতেই পারে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ইতোমধ্যে এটিকে ‘মানসিক অসুখ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এবং এর উপসর্গগুলো তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।[২]
যখনই কারো মধ্যে—
১) ভিডিও গেম খেলার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের অভাব পরিলক্ষিত হয়,
২) গেমিং-কে অন্যসব কাজের ওপরে প্রাধান্য দেয়া হয়,
৩) ক্ষতিকর প্রভাব জানা সত্ত্বেও যখন তা ছাড়তে পারেনা কিংবা খেলার তীব্রতা বাড়ায়,
তখনই বুঝতে হবে যে ঐ ব্যক্তিটি গেমিং ‘ডিসঅর্ডার’-এ ভুগছে।
★ক্ষতিকর যত দিক:
অনলাইন ভিডিও গেমে আসক্তরা বহুবিদ শারীরিক ও মানুসিক সমস্যায় ভুগেন। যার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। যেমন,
১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরিন ওয়াদুদ বলেন, “প্রতিনিয়ত ভিডিও গেম খেললে শরীরে এক ধরণের হরমোন নিঃসরণ হয়। এতে,
•শিশু সব কিছু নিয়েই উত্তেজিত হয়ে পড়ে।
•বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে যায়।
•মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়।
——[৩]
তাছাড়াও এই গেম-আসক্তি,
২. মানুষের মূল্যবান সময়ের অপচয় করে,
৩. পড়াশোনায় অমনোযোগী করে তুলে,
৪. সামাজিক বিচ্ছিনতা সৃষ্টি করে, (Social Phobia) [৪]
৫. আচরণগত ভারসাম্য নষ্ট করে, (Mood disorders)[৫]
৬. বিভিন্ন বিষয়ে হতাশা সৃষ্টি করে,[৬]
৭. Somatisation নামক মানসিক রোগ সৃষ্টি করে,[৭]
৮. ঘুমে বেঘাত ঘটায়,[৮]
৯. উন্নত জীবন গঠনে বাধাগ্রস্ত করে,
১০. সহিংস্র আচরণে উদ্বুদ্ধ করে। যেমন- ভিডিও গেম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে কুখ্যাত অপরাধীরা ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।[৯]
১১.অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কেননা কোনো কোনো গেম টাকা দিয়ে কিনে খেলতে হয়। আবার পরবর্তি ধাপে যাওয়ার জন্যও অর্থ খরচা করতে হয়।
১২. ব্যক্তিগত অন্যান্য দক্ষতা নষ্ট করে ফেলে,
১৩. অসহিষ্ণু বা সহ্য ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে,
১৪. মাথা ব্যথা ও চোখের সমস্যা সৃষ্টি করে,
১৫. মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল রাখে। ফলে শয়তান তাদের উপর ক্ষমতা লাভ করে, সৎ পথ থেকে বিচ্যুত করে।[১০]
১৬. অনেক সময় গেম-আসক্তরা আত্মহত্যা পর্যন্ত করে।[১১]
★উত্তরণের পথ/উপায়:
যে কোনো প্রকারের আসক্তিই হোক না কেন, তা থেকে একদিনেই ফিরে আসা সম্ভব নয়। কাজেই গেম-আসক্তি থেকেও যে রাতারাতি মুক্তি মিলবে; এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। সুতরাং ধীরে ধীরে পরিকল্পিতভাবে ‘নীড়ে’ ফেরার চেষ্টা করতে হবে। আর এজন্য নিচের বাতলানো পরামর্শগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে।
প্রথমত,
গেম খেলার ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। তারপর আল্লাহর নিকট বেশি বেশি দু’আ করতে হবে। কায়মনোবাক্যে বলতে হবে “হে আমার রব, আমি তো এই আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে চাই। তুমি সহায়তা করো হে আল্লাহ, তুমি সহায়তা করো।”
তারপর মনের কোণে সর্বদা এই ভয় রাখতে হবে যে, আমার রব তো আমার সবকিছুই দেখছেন।[১২] তিনি তো আমাদের সৃষ্টি করেছেন কেবল তাঁরই ইবাদতের জন্য।[১৩] তো এই গেম খেলা তো কোনো ইবাদতের পর্যায়ে না। নিঃসন্দেহে এটা সময়ের অপচয়! আর আল্লাহ তো বলেছেন— অপচয়কারী শয়তানের ভাই![১৪] তো আমি তো শয়তানের ভাই কখনোই হতে চাই না, হতে পারি না!
কাজেই এই বিষয়গুলো গভীরভাবে উপলব্ধি করে গেম ছেড়ে দেয়ার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে।
দ্বিতীয়ত,
তাবলীগে চিল্লা লাগানো।
কারো যদি সময় ও সুযোগ থাকে, তবে এই আসক্তি দূরীকরণে সবচে’ কার্যকরি উপায় হলো এটি। সেখানে একজন গেমার সবসময় একটি ঈমানি পরিবেশ পাবে। তালীম, তারবিয়াতসহ বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারবে। ফলে গেম খেলার সুযোগ আর হয়ে ওঠবে না। এতে করে তার দুইটি উপকার হবে। যেমন-
১) সে ঈমানে ও আমলে সমৃদ্ধ হবে,
২) দীর্ঘদিন গেম না খেলার কারণে আসক্তি দূর হয়ে যাবে।
তৃতীয়ত,
কিছু ভালো বন্ধু নির্বাচন করতে হবে। পড়াশোনার ফাঁকে যে সময়টিতে গেম খেলার সমূহ সম্ভাবনা থাকে, সেই সময়টুকু তাদের সঙ্গে দ্বীনি আলোচনা করবে।
চতুর্থত,
যখনই গেম খেলার জন্য মন ‘আনচান’ করবে, ঠিক তখনই মোবাইলটাকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে। যেমন, সেটি ডয়ারে রাখতে পারে কিংবা কাছের কোনো বন্ধু থাকলে তার নিকট জমা রাখতে পারে। যখন এই ইচ্ছা দূর হবে তখন আবার মোবাইল নিয়ে নিবে।
পঞ্চমত,
গেম খেলা থেকে অধিক আনন্দদায়ক কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে। সাধারণত যে অবসর সময়টুকুতে গেম খেলার তীব্র ইচ্ছা জাগে, সে সময়টুকুতে হালাল কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে মস্তিষ্ক গেমিংয়ের দিকে না গিয়ে হালাল বিনোদনের দিকে ধাবিত হয়।
ষষ্ঠত,
কোনো বন্ধু বা এমন কাউকে বলে রাখা যে, “যখনই তুমি আমাকে গেম খেলতে দেখবে, সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটা কেড়ে নিবে। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেরও তা করবে; যাতে করে আমি এই আসক্তি থেকে মুক্তি পাই।”
সপ্তমত,
অনলাইনে বেশ কিছু অ্যাপ পাওয়া যায়, যেগুলো মোবাইলে বা কম্পিউটারে ‘ইনস্টল’ করে রাখলে গেম খেলা থেকে বিরত থাকা যায়। কাজেই সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে।
অনলাইন গেম-আসক্তি তরুণ প্রজন্মের জন্য যে কত বড় সমস্যা এবং এ সমস্যা যে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ও প্রকট হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সমস্যার সমাধানকল্পে এখনই সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সন্তানের ব্যাপারে অভিভাবকদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে।
গেম-আসক্তি থেকে উত্তরণের জন্য বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে যে পরামর্শগুলো দেয়া হলো, তা প্রয়োগ করা যেতে পারে। ইনশা আল্লাহ আশা করা যায়; এ থেকে মুক্তি মিলবে। তাছাড়াও নিজের জন্য ভালো; এমন অভিনব সব ব্যবস্থা যে কেউ গ্রহণ করতে পারে।
সবশেষে দু’আ করি মহান আরশের অধিপতি এক আল্লাহর কাছে; যে সকল ভাই-বোনেরা এ সমস্যায় জর্জরিত এবং ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে একবারেই আশাহত, তিনি যেন তাদের সহায় হোন। এই উম্মাহর তরুণ-যুবারা যেন সঠিক পথে ফিরে আসে এবং তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইসলামী সভ্যতা-বিনির্মাণে এগিয়ে আসে—সেই কামনাই করি।
আমীন, আমীন—ইয়া রাব্বুল আ’লামীন।
________•••_____
জাযাকাল্লাহ সবাইকে।
__________________________
★Reference:
[১]=https://www.who.int/news-room/q-a-detail/gaming-disorder
[২],[৩]=https://www.bbc.com/bengali/news-42556619
[৪],[৫],[৬],[৭],[৮]=https://en.m.wikipedia.org/wiki/Video_game_addiction
[৯]=https://roar.media/bangla/main/awareness/violent-crimes-tied-to-video-games/amp
[১০]= সূরা যুখরুখ : আয়াত : ৩৬-৩৭
[১১]=https://www.prothomalo.com/technology/article/1320976
[১২]=সূরা আল মুমিন : আয়াত : ২০
[১৩]= সূরা আয যারিয়াত : আয়াত : ৫৬
[১৪]= সূরা বনি ইসরাঈল : আয়াত : ২৭
[পরিশিষ্ট]
★[Social Phobia]= সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। অর্থাৎ একঘেয়েমি স্বভাব সৃষ্টি করে।
★[ Mood disorders ]=কখনো নিজেকে পৃথিবীর সবচে’ সুখি মানুষ ভাবা, কখনো হীনমন্যতায় ভুগে আত্মহত্যা করতেও উদ্বত হওয়া!
★[ Somatisation ]=এক ধরনের মানসিক সমস্যা যেখানে ব্যক্তির মধ্যে শারীরিক সমস্যা/লক্ষণ দেখা দেয় কিন্তু তার এই শারীরিক সমস্যার কোন শারীরিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
—–
#মিম্বার_প্রতিযোগিতা_২০২০